ডুয়ার্স ভ্রমণ ২
ডুয়ার্স ভ্রমণ ২
Magazines updated 4 years ago

ডুয়ার্স ভ্রমণ ২

Book

ডুয়ার্স ভ্রমণ ২

প্রথমে তরাই।
এখানে আমার সব বন্ধুদেরই দুচাকার গাড়ি আছে। আমারও একটা ছোট দুচাকার গাড়ি আছে। সেই নিয়েই আমারা বন্ধুর দল মাঝে মধ্যেই বেরিয়ে পড়ি। তবে শুধু ডুয়ার্স নয়। তরাইও খুব সুন্দর জায়গা। কিন্তু সে রকম পরিকাঠামো গড়ে না ওঠার জন্য ভ্রমণ রসিকদের কাছে ব্রাত্য থেকে গেছে । শিলিগুড়ি থেকে কাছেই মাত্র পনের কিলোমিটার দুরত্বে সুকনা। একটা সুন্দর রেল স্টেশনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক সুন্দর জনপদ। সমতলের শেষ আর পাহাড়ের শুরু। দুপাশে ঘন অরণ্য। মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংকচুয়ারি। দক্ষিণে তিরতির করে বয়ে চলা পাহাড়ি নদী রংটং। স্থানীয় বাসিন্দা অধিকাংশই নেপালি, কিছু চা বাগানের আদিবাসী শ্রমিক। একটা ফরেস্ট অফিস, ফরেস্ট মিউজিয়াম নিয়ে সুন্দর জায়গা। সুকনায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে পাহাড়ে ওঠা। মাঝে মাঝেই টয় ট্রেন লাইনের রাস্তা ক্রস করা। মসৃণ পাকা রাস্তা ধরে সাত কিলোমিটার উপরে আরেকটি সুন্দর রেল স্টেশন রংটং। বেশ কিছুটা ঘুরে পাহাড়ের একেবারে গায়ে লাগানো স্টেশন। রেল লাইনের গা ঘেঁসে কালচে নীল রঙয়ের খাড়া পাহাড় উঠে গেছে আকাশ ছোঁয়ার উদ্দেশ্যে। সারাদিন নানা রকম পাখির ডাক। ঝিঁঝিঁর ঐকতান। দিনে দু তিনবার ট্রেন চলাচল করে। রাস্তা পার হলেই তিন চারটি দোকান, মোমো, চাউমিন, চা ইত্যাদির। দোকানগুলির পিছনেই খাড়া পাহাড় নেমে গেছে অনেক গভীরে। ঘন গাছপালায় ঢাকা। অধিকাংশ সময়ই মেঘ নেমে এসে সবকিছু ভিজিয়ে দেয়। অপুর্ব রোমান্টিক একটি জায়গা। এক বেলার ভ্রমণের জন্য আদর্শ। তবে জোঁকের জন্য কুখ্যাত। তরাই, ডুয়ার্স সর্বত্র, বর্ষার সময় থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
এই রংটংএ যাওয়া নিয়ে কতগুলো ছোটছোট ঘটনা আছে। যখন কলেজে পড়তাম একবার দু তিন বন্ধু মিলে সাইকেল নিয়ে রংটং গিয়েছিলাম। সে সময় শিলিগুড়ির দার্জিলিং মোড় থেকে শুকনা পর্যন্ত কোনো বাড়ি ঘর ছিল না, দুপাশে ধান ক্ষেত, শাল বন এর মধ্য দিয়ে সরু পাকা রাস্তা ধরে সুকনা হয়ে দার্জিলিং যেতে হত। ঝুক গয়া আসমান সিনেমায় এই পথের অনেকটা দৃশ্য আছে। সুকনা থেকে রংটং সাইকেলে ওঠা প্রচণ্ড কষ্টকর ছিল।
এর অনেক দিন পরে, আমার এক বন্ধু স্বপনের ছেলে ঋজু তখন এস আই টি তে পড়ছে। খড়গপুর থেকে স্বপন আমাকে ফোন করে বলল ওর ছেলে ঋজুকে কিছু টাকা দিয়ে আসতে। সেই মত একদিন সকালে আমি আমার দু মেয়েকে নিয়ে সুকনা চললাম। ঋজুকে টাকা দিয়ে আমরা হেঁটে রংটংএর দিকে চললাম। তখন রাস্তা খুব সুন্দর হয়ে গেছে। চওড়া ঝকঝকে, দু পাশে সাদা বর্ডার। রাস্তার এক পাশে রেল লাইন। পাহাড়ের কোল ঘেঁসে আকাশ ছোঁয়া ঘন বন। মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়ায় ভেসে আসছে বুনো ফুলে গন্ধ। ঝিঝির ডাক। ছোটছোট বানরের দল লাফালাফি করছে। কয়েকটা রাস্তার পাশে বসে আছে। আমরা হেঁটে হেঁটে পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। রাস্তায় গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। আমার ছোট মেয়ে বুবু হঠাৎ রাস্তার উপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম, করছিস কি? ও বলল, বাবা, শিলিগুড়িতে বাড়ি করতে হবে না। এখানেই বাড়ি কর। আমি এখানেই থাকব। এখান থেকে যাব না। এতেই সুকনা রংটং এর বর্ণনা হয়ে যায়।
কোনো এক পঁচিশে ডিসেম্বর ঃ সুকনা থেকে বাঁদিকে একটা রাস্তা বেরিয়ে গেছে খাপ্রেল মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টের মধ্য দিয়ে কার্শিয়াং এর উদ্দেশ্যে। সুকনা ছাড়ার পরে বেশ কিছুটা জংগলের মধ্যে দিয়ে দিয়ে একটা ‘এস’ বাঁক নিয়ে অনেকটা নিচে নেমে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যদিয়ে শিমুলবাড়ি চা বাগানের কাছে গিয়ে মাটিগাড়া মেন রোডে মিশেছে। অসাধারণ সুন্দর একটা রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে গাড়িধুরা। সেখানে মোমো, চা সহযোগে প্রাতঃরাশ সেরে দুচাকার গাড়ি নিয়ে আবার এগিয়ে যাওয়া। সামান্য এগিয়ে বাঁদিকে টার্ন নিয়ে সোজা পথ দুপাশের চা বাগানের মধ্যদিয়ে, জংগলের মধ্যদিয়ে দুধিয়া।

তরাইয়ের আর একটি সুন্দর জায়গা। অল্প কিছু বাড়ি ঘর। অধিকাংশই নেপালিদের। কয়েকটা দোকান। পিছন দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি বালাসন। বালাসনের ওপার থেকেই শুরু হল পাহাড়। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে উঠে গেছে মিরিকের উদ্দেশ্যে। এই দুধিয়াই পিকনিকের সময় পা ফেলার জায়গা পাওয়া যায় না। প্রচণ্ড ভিড় হয়। আমরা দুধিয়া ব্রিজ পার হয়ে মিরিকের পথ না ধরে পাথুরে সঙ্কীর্ণ রাস্তা ধরে উপরে উঠলাম। বেশ কিছুটা ওঠার পর একটা প্রাচীন মন্দির। মূক্তিনাথ মন্দির। খুব সুন্দর জায়গা। রাস্তার ডান দিকে মন্দির, বাঁ দিকে গভীর খাত। অনেক নিচে তিরতির করে বয়ে চলেছে এক পাহাড়ি স্রোতা। ফেরার পথে এবার আর গাড়িধুরা সুকনার পথ নয়। আমরা দুধিয়া পার হয়ে ডান দিকে বাঁক নিয়ে পানিঘাটার পথ ধরলাম। পানিঘাটার আগের পথটুকু অসাধারণ। ডান দিকে খাড়া পাহাড়, আর বাঁ দিকে বালাসন নদী। তার মাঝে সরু আঁকাবাঁকা পথ আমাদের পৌঁছে দিল পানিঘাটা। পানিঘাটা একটা ছোট্ট জনপদ, তবে বেশ ঘিঞ্জি। প্রচুর দোকানপাট, সরকারী অফিস। নেপালি, বাঙালি মিলে মিশে বাস করে। পানিঘাটা থেকে রাস্তাটা পুরোটাই সমতল, মসৃণ ও সরল রেখার মত। পাঁচ কিলোমিটার পর এসে মিশেছে কদমা মোড়ে। ইংরেজি টি এর মত। ডান দিকে চলে গিয়েছে নকশালবাড়ি, বাঁ দিকে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট, ত্রিহানা চা বাগান হয়ে বাগডোগরা। এই ত্রিহানা থেকে একটা অপেক্ষাকৃত কম ব্যাবহৃত পথ হাতি অধ্যুষিত ঘন জংগলের মধ্যদিয়ে চলে গেছে জংলীবাবার মন্দিরে। শিবরাত্রির সময় এখানে প্রচুর জন সমাগম হয়। বিরাট মেলা বসে। সেনা বাহিনীর লোকেরাই সব কিছু পরিচালনা করেন। যাই হোক, আমরা ত্রিহানা চা বাগানের মধ্যদিয়ে বাগডোগরা এসে দুপুরের খাওয়া সারলাম বিকেল বেলায়।
আর একবার সুকনা শিমুলবাড়ি হয়ে মাটিগাড়া মেন রোড ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে সোজা এগিয়ে চললাম রোহিণীর উদ্দেশ্যে। রোহিণী থেকে কারশিয়াং মাত্র এগারো কিলোমিটার। এই পথে দার্জিলিং অনেকটাই সর্টকার্ট হয়। এই পথ চালু হওয়ার পর রংটং, তিনধরিয়া হয়ে দার্জিলিং যাওয়ার পথ একেবারেরই ব্যাবহার করা হয় না। স্থানীয় লোকেরা ঐ পথ ব্যাবহার করেন।
রোহিণী থেকেই পাহাড় শুরু। দুচাকার গাড়ি নিয়ে অনেকটা উপরে উঠে এক পাহাড়ের চুড়ায় রোহিণী মন্দির। মন্দিরের বিগ্রহ বলতে পাহাড়ের চুড়ায় এক খণ্ড বিশালাকৃতি শিলা। সুন্দর জায়গা। ওখান থেকে অনেকটা নিচে অনেক দূরে শিলিগুড়ি দেখা যায়। তরাইয়ে রোহিণীও একটা দারুণ একবেলার বেড়াবার জায়গা। কোলকাতা থেকে কেউ এলে আমি তাদেরকে কাছাকাছির মধ্যে রোহিনী নিয়ে আসি। ভাল লাগে এখানে এলে।

মাঝে বেশ কয়েক বার গিয়েছি গুলমা। একটা ছোট রেল স্টেশন। তবে দূরপাল্লার প্রচুর ট্রেন এই পথে চলে। শিলিগুড়ি থেকে চম্পাসারির মধ্যদিয়ে যে রাস্তাটা সোজা উত্তর দিকে চলে গিয়েছে সেটাই গুলমা স্টেশনে গিয়ে শেষ হয়েছে। স্টেশনের সামনেই একটা বিশাল প্রাচীন বটগাছ । বেশ কিছুটা উপরে স্টেশন। পুব পশ্চিমে লাইন চলে গেছে। পুব দিকে একটু দূরেই মহানন্দার ওপরে রেল ব্রিজ। স্টেশনের পিছনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা, গোচারণ ভূমি। তারপর গভীর জঙ্গল। হাতি, চিতাবাঘের আস্তানা। এ ছাড়াও প্রচুর ময়ূর, ধনেশ পাখি এখানে উড়ে বেড়ায়। ফাঁকা তৃণভূমিতে প্রচুর গরু চরে বেড়ায়। জঙ্গলের পরেই নীল পাহাড়ের সারি। উপরে সাদা অলস মেঘের আনাগোনা। অপুর্ব সুন্দর নিরিবিলি জায়গা। এখানেও বেশ কয়েকবার গিয়েছি। প্রথমবার আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু দুলালদার সাথে

গুলমায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমি আর দুলালদা অন্য একটা অচেনা পথ ধরলাম। ঘন জঙ্গলের মধ্যদিয়ে, চা বাগানের মধ্য দিয়ে প্রায় সাত আট কিলোমিটার পথ চলার পর এসে পৌছুলাম সুকনায়। এ পথে যে সুকনা আসা যায় জানা ছিল না। দারুণ রোমাঞ্চকর পথ এটা।
গুলমার পাশে মহানন্দার ঘাট একটা সুন্দর জায়গা। নদীর স্রোতে পাহাড় থেকে নেমে আসা প্রচুর পাথর ছড়ানো। মাঝে দু তিনটি স্রোতধারায় বয়ে চলেছে মহানন্দা। নদী পার হলেই ঘন অরণ্য। দিনের বেলায়ই অন্ধকার হয়ে থাকে। আমার বন্ধু ধ্রুবজ্যোতিকে একবার ওখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর একবার আমার বড় মেয়ে মনা (ব্রততী)কে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওদের খুব ভালো লেগেছিল।

0
1
1
0
0
0
0
0
0
0 Comments

Subscribe to our email newsletter & receive updates right in your inbox.

Follow Us on Facebook